অর্থনীতি

পাচারের অর্থ ফেরাতে আপসের কথা ভাবছে সরকার

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ। এ জন্য প্রয়োজনে পাচারকারীদের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে এই অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।

এস আলম ও বেক্সিমকোসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ দেশ থেকে আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

শুক্রবার বাংলাদেশ ব্যাংকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে ‘অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও সমসাময়িক ব্যাংকিং’ বিষয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

গভর্নর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই ‘আউট অব কোর্ট সেটেলমেন্ট’ বলে একটা কথা আছে। সব জিনিসে সবসময় মামলায় দীর্ঘসূত্রিতায় যাওয়ার মানে হয় না। বিশ্বের অন্য দেশও আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কিছু উদ্যোগ নিয়ে থাকে। আপসের মাধ্যমে হলে অনেক সময় পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনা যায়। তবে সবার আগে আমাদের দেশ থেকে কোন দেশে কী পরিমাণ অর্থ-সম্পদ পাচার হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য আগে সংগ্রহ করতে হবে। যত বেশি সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকবে ততবেশি দর কাষাকষি করার সুযোগ থাকবে।

বড় অর্থপাচারকারীদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

গভর্নর বলেন, অর্থপাচারকারীদের খোঁজ নিতে কিছু বেসরকারি ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তারা সেই সম্পদ খুঁজে পেতে সহায়তা করবে। তারপর তথ্য নিয়ে সে দেশের সরকারি সংস্থার সঙ্গে আলোচনায় বসব। অর্থ ফেরত আনতে হলে সে দেশের আইনি বিষয়টিও আমাদের মেনে চলতে হবে। তবে ইতোমধ্যে তাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে এবং ভালোভাবে সহযোগীতাও করছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. আহসান বলেন, চট্টগ্রামের একটি বড় গ্রুপ (এস আলম) দেশে থেকে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি থেকে দেড় লাখ কোটি টাকার মতো পাচার করেছে। বেক্সিমকো গ্রুপসহ আরও কয়েকটি বড় গ্রুপের হিসাব করলে তার পরিমাণ প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ কোটি টাকা হবে। তাছাড়া দেশের নন পারফর্মিং প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার বড় অংশই পাচার হয়েছে বলে বাকি টাকা পাচার না হলেও আদায় করা সম্ভব হয়নি।

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি আদায় না হওয়া এসব ঋণ অর্থঋণ আদালতের মাধ্যমে আদায় করা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এভাবে বিপুল অর্থ পাচার হওয়ার সুযোগ ছিল না। এর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ধারণা থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। যদি দুদক বা রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা প্রমাণসহ আমাদের কাছে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ দেয় তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হয়।

তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন ভালো। আমাদের রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি, রপ্তানি আয় সব কিছুই ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। রিজার্ভ স্থিতিশীল রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকসহ যেসব বেসরকারি ব্যাংক অনিয়ম ও লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল সেসব ব্যাংকও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

বলা যায়, ব্যাংকগুলো সংকট কাটিয়ে গ্রাহকদের আস্থার জায়গায় ফিরতে পেরেছে।

ড. আহসান এই মনসুর বলেন, মানি লন্ডারিংয়ে বাংলাদেশ একটা বড় ভিকটিম। এই দেশের ব্যাংকিং খাতে কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী মানি লন্ডারিং করে সম্পদ চুরি করে বাইরে নিয়ে গেছে। আমরা সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিউর’ রোগের উৎপত্তি রোধ করা প্রধান দায়িত্ব। রোগ সারানোর দায়িত্ব হচ্ছে পরে। চুরি হওয়ার পরে বুদ্ধি বাড়িয়ে লাভ নেই। চুরি হওয়ার আগেই ঠেকানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনোভাবে অর্থ পাচার না হয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার যে উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য তা একেবারেই নতুন। পদ্ধতিগতভাবে এ ধরনের সমস্যা আগে মোকাবেলা করিনি। সেজন্য আমাদের অনেক শিখতে হচ্ছে। এটা তো দেশের আইনে হবে না। বিদেশিদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের আইনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করতে হবে।

গভর্নর বলেন, আমাদের রিজার্ভ স্থিতিশীল আছে। রপ্তানি বাড়ছে। বিভিন্ন রকমের গোলযোগ আন্দোলন সত্ত্বেও রপ্তানি মুখ থুবড়ে পড়েনি, বাড়ছে। ডাবল ডিজিট গ্রোথ দেখতে পাচ্ছি। রেমিট্যান্সের প্রবাহ উৎসাহব্যঞ্জক। এর ধারাবাহিকতা থাকবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনমিক এক্সটারনাল সেক্টরে একটা স্বস্তির জায়গায় আমরা চলে এসেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *