আন্তর্জাতিক

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকায় ওয়াশিংটনে চরম অস্বস্তি

আঞ্চলিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া দুটি বৈরি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ যখন শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যায়, তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সেটিকে স্বাগত জানানোটাই রেওয়াজ।

শুক্রবার ইরান ও সৌদি আরব যখন সাত বছর পর তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুন-স্থাপনে রাজি হলো, তখন বাকি বিশ্ব তাই করেছে।

জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে বিশ্বনেতারা বিবৃতি দিয়ে এই সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তবে ব্যতিক্রম ছিল দুটি দেশের প্রতিক্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে দুটি দেশই ইরানকে চরম বৈরি হিসেবে দেখে, ইরানও এই দুটি দেশকে তাদের দেশের নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য এক নম্বর হুমকি বলে বিবেচনা করে।

হোয়াইট হাউজের একজন মুখপাত্র ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‘সতর্ক ভাষায়’ স্বাগত জানালেও এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন এটি টিকবে কি না।

হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ইরান তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করবে কি না, তা দেখতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া যাই হোক, বেশিরভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতা ওয়াশিংটনে মারাত্মক অস্বস্তি তৈরি করেছে।

ইসরায়েল অবশ্য প্রকাশ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এখনো জানায়নি। কিন্তু ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং মন্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, তেহরান ও রিয়াদের মধ্যে এই সমঝোতা তাদের মোটেই খুশি করেনি।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব মারাত্মকভাবে সহায়ক হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলও এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ‘শত্রুর শত্রু আমাদের মিত্র‘ নীতি অনুসরণ করে ইরানের বৈরি কিছু উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

স্বাভাবিকভাবেই ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে যদি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং ভবিষ্যতে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেটি উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন বিন্যাস তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল- দুটি দেশই মনে করে এই নতুন পরিস্থিতি কোনোভাবেই তাদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।

ওয়াশিংটন কেন অস্বস্তিতে

বেইজিং থেকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতার খবর যখন প্রথম এলো, সেটি ওয়াশিংটনে একই সঙ্গে বিস্ময় ও শঙ্কা তৈরি করে।

এর মূল কারণ অবশ্য ইরান-সৌদি আরব সমঝোতা নয়, তাদের অস্বস্তি এবং শঙ্কার মূল কারণ এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে সব ধরনের সংঘাতে রেফারির ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাদের সেই প্রভাব বলয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যেভাবে চীন ঢুকে পড়ছে- সেটি মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের জন্য সাংঘাতিক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বেলুনকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে গত কিছুদিন ধরে মারাত্মক টানাপোড়ন দেখা যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে চীনের এই ভূমিকাকে বিশ্বজুড়ে মার্কিন একাধিপত্যের প্রতি আরেকটি চ্যালেঞ্জ বলে বর্ণনা করছেন কেউ কেউ।

যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কূটনীতিক ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের ফেলো জেফরি ফেল্টম্যানের ভাষায়, বেইজিংয়ের এই ভূমিকাকে ‘বাইডেন প্রশাসনের মুখে চপেটাঘাত‘ এবং চীন যে এক উদীয়মান শক্তি-  সেভাবেই দেখা হবে।

চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা

বহু বছর ধরেই চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম ঘোষিত স্তম্ভ ছিল ‘অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো’। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে যে নতুন ঝোঁক, তাতে এই নীতির ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘাতে তাদের সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করতে দেখা যাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসনের একজন শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ড্যানিয়েল রাসেল রয়টার্সকে বলেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, ওয়াশিংটনের জন্য সেটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে।

তিনি বলেন, যে সংঘাতে চীন কোনো পক্ষ নয়, সেখানে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে এভাবে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা খুবই ব্যতিক্রমী এক ঘটনা।

তিনি বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে কি এরকমই আমরা দেখব? চীনের প্রেসিডেন্ট শি যখন মস্কো সফর করবেন, তখন সেখানে রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার যে চেষ্টা চীন করবে, এটি কি তার পূর্বাভাস?

চীনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে অনেকে সন্দিহান হয়ে উঠেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান রিপাবলিকান সদস্য মাইকেল ম্যাককল তো চীনকে ‘শান্তির মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে মানতেই নারাজ। তার ভাষায়, চীন কোন দায়িত্বশীল শক্তি নয় এবং একজন নিরপেক্ষ এবং ন্যায্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায় না।

এ ধরনের মধ্যস্থতায় চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে কোনো কোনো বিশ্লেষক বিশ্ব বলয়ে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির ইঙ্গিত বলে মনে করছেন।

ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেন, কোন লুকোচুরি না করে বেইজিং যে বার্তা এখানে পাঠাতে চাইছে, তা হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিপরীতে চীন এক উদীয়মান এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থিত হতে চাইছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *