ঢাকার মহাখালী আর বনানী থেকে গত দুই দিনে যে ব্যক্তির লাশের খণ্ড খণ্ড অংশ উদ্ধার করা হয়েছিল, তার প্রথম স্ত্রীই তাকে হত্যা করেছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ বলছেন, ময়না মিয়া নামের ৪০ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকে ‘বেশি মনোযোগ’ দেওয়ায় ক্ষোভ থেকে তাকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছেন তার প্রথম স্ত্রী ফাতেমা বেগম শিল্পী।
“জুসের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে হাত ও মুখ বেঁধে ছুরি দিয়ে গলা কেটে হত্যার পর স্ত্রীই তাকে দা দিয়ে কুপিয়ে ছয় টুকরা করে।”
( নিহত ময়না মিয়া পেশায় ছিলেন অটোরিকশা চালক )
রোববার রাত ৯টার দিকে বনানী থানা এলাকার মহাখালী কাঁচা বাজারের কাছে সড়কে একটি প্লাস্টিকে ড্রাম থেকে এক ব্যক্তির হাত-পা-মাথাহীন দেহখণ্ড উদ্ধার করে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা সে সময় জানিয়েছিলেন, বৃষ্টির মধ্যে ড্রামটি সেখানে ফেলে গিয়েছিল কেউ।
এরপর সোমবার ভোররাতে মহাখালী বাস টার্মিনালে একটি ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা হয় চারটি খণ্ডিত হাত-পা। তখনও মাথাটির সন্ধান পাওয়া যায়নি।
উদ্ধার করা ওই হাত থেকে আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেইজের সঙ্গে মিলিয়ে পুলিশ জানতে পারে, নিহতের নাম ময়না মিয়া, বাড়ি কিশোরগঞ্জে।
এরপর সোমবার দুপুরে বানানীর একটি অফিস থেকে ময়না মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা বেগম শিল্পীকে (৩২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার দেওয়া তথ্যেই সোমবার বিকালে বনানী লেক থেকে ময়না মিয়ার মাথা উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুন বলেন, ঢাকার বানানীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির একটি টিনশেড ঘরে প্রথম স্ত্রী ফাতেমাকে নিয়ে থাকতেন ময়না মিয়া। আর দ্বিতীয় স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ফাতেমার ঘরে ১০ ও ৬ বছর বয়সী দুটি সন্তান রয়েছে ময়নার।
“জিজ্ঞাসাবাদে ফাতেমা বলেছেন, তাকে সময় না দিয়ে ময়না মিয়া দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিনকে বেশি সময় দিত। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে সে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।”
স্বামীকে খুন করার আগে ফাতেমা তার দুই সন্তানকে ময়মনসিংহে তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বলে পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ময়না মিয়ার একটি অটোরিকশা আছে কিশোরগঞ্জে। তিনি সেটা নিজে চালাতেন, আবার কখনও অন্য চালককে ভাড়াও দিতেন। সেখানে দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গেই তিনি বেশিরভাগ সময় থাকতেন।
প্রথম স্ত্রী ফাতেমা বনানী এলাকায় একটি বেসরকারি অফিসে রান্নার কাজ করেন। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ের পর থেকেই সংসার খরচের টাকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সমস্যা চলছিল। গত ২৩ মে থেকে ময়না মিয়া ঢাকায় ফাতেমার সঙ্গেই ছিলেন।
ফাতেমাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশ কর্মকর্তা হারুন বলেন, “স্বামীকে হত্যার পরিকল্পনা করার পর ফাতেমা কড়াইল এলাকা থেকে দুই পাতা ঘুমের ট্যাবলেট কিনে আনেন। শুক্রবার রাতে জুসের সাথে স্বামীকে তা খাইয়ে দেন। তাতে পরদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত ময়না মিয়া ঘুমে অচেতন থাকেন।
“সন্ধ্যার দিকে কিছুটা জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি স্ত্রীকে গালমন্দ করতে শুরু করেন এবং আক্রমণ করতে গিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়েন। এ সময় তিনি ‘পানি পানি’ বলে আর্তনাদ করলে ফাতেমা আবারও ঘুমের ট্যাবলেট মেশানো জুস তার মুখে ঢেলে দেন।”
ফাতেমা পুলিশকে বলেছেন, ময়না আবার নিস্তেজ হয়ে খাটে পড়ে গেলে তিনি ওড়না দিয়ে তার দুই হাত শরীরের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন এবং টেপ দিয়ে মুখ আটকে দেন।
যুগ্ম কমিশনার হারুন বলেন, “ফাতেমা একটি চাকু দিয়ে ময়নার গলা কাটা শুরু করলে তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। নিজের হাত মুক্ত করে ময়না তার হাতে খামচি ও কামড় বসিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে দুজন খাট থেকে পড়ে গেলে ফাতেমা ভিকটিমের বুকের উপরে উঠে তার গলার বাকি অংশ কেটে দেয়।”
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্বামীকে হত্যার পর সারা রাত লাশের পাশেই ছিলেন ফাতেমা। সকালে লাশ গুম করার জন্য তিনি চাকু আর দা দিয়ে ময়নার লাশ ছয় টুকরা করেন এবং খণ্ডিত অংশ তিন ভাগ করেন।
পুলিশ কর্মকর্তা হারুন বলেন, “১৩ শ টাকা দিয়ে রিকশা ভাড়া করে প্রথমে আমতলী এলাকায় ড্রামে ভরা শরীরের মূল অংশ ফেলে দেন ফাতেমা। পরে মহাখালীর একটি বাস কাউন্টারের সামনে দুই হাত, দুই পা ভর্তি ব্যাগ রেখে চলে যান।
“সেখান থেকে বাসায় এসে কাটা মাথা আরেকটি ব্যাগে ভরে তিনি বনানী ১১ নম্বর ব্রিজের পূর্বপ্রান্তে যান। গুলশান লেকে সেই ব্যাগ ফেলে দিয়ে তিনি বাসায় ফিরে যান।”
এক প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, এ পর্যন্ত তদন্তে তারা যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে ফাতেমা একাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
রিকশা চালক কিছু জানত কি না- এই প্রশ্নে পুলিশের এই যুগ্ম কমিশনার বলেন, “হয়ত কিছু বুঝতে পেরেছে। পুলিশ সেই রিকশাচালককে খুঁজছে।”
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ফাতেমার দেওয়া তথ্যে তার বোরখা, ভিকটিমের রক্তমাখা জামাকাপড়, ছুরি, দা, পেয়ালা ও শীল-পাটা উদ্ধার করা হয়েছে।
ময়নার দ্বিতীয় স্ত্রী নাসরিন বাদী হয়ে বনানী থানায় একটি মামলা করেছেন, সেখানে ফাতেমাকেই একমাত্র আসামি করা হয়েছে।