রেলের সুদিনের আশায় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আনা ১০টি ইঞ্জিন ক্রয়ে অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। রেলের অতিরিক্ত সচিব মো. ফারুকুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের শক্তিশালী তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন নিয়ে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বুধবার জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে রেলওয়ে মহাপরিচালকসহ পদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। ৭ মাস ধরে পড়ে থাকা এসব ইঞ্জিন সংযোজন-বিয়োজন করে কাজে লাগানো যায় কিনা সে ধরনের প্রস্তাবও দিয়েছেন পদস্থদের কেউ। তবে এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে জোরালো আপত্তিও তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ইঞ্জিন ক্রয়ে যে অনিয়ম হয়েছে তার শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। ইমেজ সংকটে পড়বে রেল। শেষ পর্যন্ত আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যে এ কমিটি গঠনের কথা। তবে নতুন করে কমিটি গঠনকে কালক্ষেপণ হিসাবে দেখছেন বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই। কেননা এর আগে কমিটি গঠনের নির্দেশের পরও তা কার্যকর হতে ৪০ দিনের মতো লেগে যাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ হয়নি এমন অভিযোগে গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আসছে। আমরা আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছি। এ কমিটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দেবে। পুরো প্রক্রিয়ায় রেলওয়ের কেউ সম্পৃক্ত থাকলে নিশ্চিত শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা এসব ইঞ্জিন দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে ট্রেন চালাতে চাই। ইঞ্জিন খুব প্রয়োজন, এসব ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চালানো যায় কিংবা ত্রুটি না থাকলে এগুলো দিয়ে ট্রেন চালানো হবে। তবে অনিয়ম হলে কেউ ছাড় পাবে না।
কথা হয় বৈঠকে উপস্থিত প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, এসব ইঞ্জিন নিয়ে কোনো নয়ছয় করা হলে আমি তার প্রতিবাদ জানাব। আমি সরকারের বেতন নেই। দেশের জন্য কাজ করব। এসব ইঞ্জিন গ্রহণ করা হলে রেলের জন্য তা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। বুধবারের বৈঠকে হুন্দাই রোটেম ও তাদের দেশীয় এজেন্টের প্রতিনিধিরা ভুল তথ্য দিয়ে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে বলেছিল। তখন প্রকল্পের পক্ষ থেকে চুক্তির মূল কপিসহ অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়।
বর্তমানে রেলের লোকোমোটিভের (রেল ইঞ্জিন) প্রায় ৭৮ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব ইঞ্জিনে গতি না ওঠায় রেলের অনেক কিছু নতুন হলেও ট্রেন চলছে সেই পুরনো স্টাইলে- ধীরে ধীরে। রেলকে গতিশীল করতে ১২০ থেকে ১৩০ কিমি. গতিতে ট্রেন চালাতে ৭ মাস আগে ৩২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আনা হয় ১০টি ইঞ্জিন। এগুলো নিম্নমানের এবং চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইঞ্জিন না আনায় প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করতে রাজি না হলেও রেলওয়ের শীর্ষস্থানীয় দুই কর্মকর্তার ইচ্ছায় ইঞ্জিনগুলো প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন ছাড়াই গ্রহণ করা হয়। এ নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ফারুকুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়। অপর দুই সদস্য হলেন, রেলের যুগ্ম মহাপরিচালক (মেকানিকেল) তাবাসুম বিনতে ইসলাম ও বুয়েটের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে লোকোমোটিভগুলোতে দরপত্রের কারিগরি স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী তিনটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান (ক্যাপিটাল কম্পোনেন্ট) ইঞ্জিন, অলটারনেটর ও ট্রাকশন মোটর সংযোজিত হয়নি। স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী লোকোমোটিভে ইএমডিএস-৮-৭১০জি ৩ বি-টি১ মডেলের ইঞ্জিন সংযোজন করার কথা, দেওয়া হয়েছে কম ক্ষমতার ইঞ্জিন ইএমডিএস ৮-৭১০জি ৩ বি-ইএস। টিএ ১২-সিএ ৯ মডেলের অলটারনেটর সংযোজনের শর্ত ছিল, কিন্তু দেওয়া হয়েছে টিএ৯-১২সিএস৯এসই মডেলের অলটারনেটর। এ২৯০৯-৯ মডেলের ট্রাকশন মোটর সংযোজনের শর্ত ছিল, দেওয়া হয়েছে ২৯০৯ মডেলের ট্রাকশন মোটর। লোড বক্স টেস্টিং প্ল্যান্টের আওতায় ১১ ধরনের যন্ত্রাংশ সরবরাহের চুক্তি ছিল, কিন্তু তা দেওয়া হয়নি। সূত্র বলছে, রেলওয়ের একটি অসাধু চক্রের অদৃশ্য সহযোগিতায় চুক্তি ভঙ্গ করে ইঞ্জিনগুলো সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে বাংলাদেশে আনা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক নূর আহাম্মদ আগেই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ককে লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন, ইঞ্জিনগুলো রেলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার উপযোগী নয়। ঠিকাদার হুন্দাই রোটেম তাদের ইচ্ছানুযায়ী যন্ত্রাংশ সংযোজন করেছে। দরপত্রের শর্তানুযায়ী যন্ত্রাংশ সংযোজন না করা পর্যন্ত এসব ইঞ্জিন গ্রহণের সুযোগ নেই। এসব ইঞ্জিন গ্রহণ করা হলে সেটি হবে সম্পূর্ণ অনৈতিক, বেআইনি। প্রকল্প পরিচালক রেলপথ সচিবের কাছে ১৪ ডিসেম্বর লিখিতভাবে বলেছেন, এ অনিয়মের জন্য সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মঞ্জুর-উল আলম চৌধুরীও দায়ী। তার বিভিন্ন সময়ে তাকে চাপ সৃষ্টি করেছেন। রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, এ সরকারের আমলে প্রায় ৪শ অত্যাধুনিক যাত্রীবাহী কোচ আনা হয়েছে। এগুলো ১২০-১৩০ কিমি. গতিতে চালানো সম্ভব ছিল। কিন্তু শুধু নতুন ইঞ্জিনের অভাবে অত্যাধুনিক এসব কোচ দিয়ে বেশি গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে চুক্তি ভঙ্গ করে ইঞ্জিন আনার বিষয়টি সুরাহা না হতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অবশিষ্ট টাকা তুলে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলছেন, এমন প্রতারণার শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টাকা দেয়া যায় না। আমি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও বিভাগকে চিঠি দিয়ে সব জানিয়েছি। টাকা ছাড় না দেয়ার জন্য বলেছি। তারপরও যদি টাকা দেয়া হয় তার দায় আমার নয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কথা হয় রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার সঙ্গে। তিনি বলেন, বুধবার এ বিষয়ে বিশেষ বৈঠক হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী যে ইঞ্জিনগুলো সরবরাহ করা হয়নি তা প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। চুক্তির বাইরে ইঞ্জিনগুলো গ্রহণ করা হলো কেন বা এর সঙ্গে কারা জড়িত সবই বের হবে। আমরা এ বিষয়টি নিয়ে তথ্য-উপাত্ত খুঁজে বের করছি। মূল্যবান ইঞ্জিনগুলো পড়ে আছে। অতি প্রয়োজন হলেও তা ব্যবহার করতে পারছি না। ইঞ্জিন ক্রয়ে অনিয়ম, সরবরাহ এবং গ্রহণে রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা থাকলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ে মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আপনার কাছে পত্র দিয়েছেন? এ নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সবকিছুই দেখছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য হলে কাউকে রক্ষা করা হবে না। সবাইকে শাস্তির আওতায় আসতে হবে।