সারাদিন পর ঘরে ফিরে সাদামাটা খাবার খেতে অভ্যস্ত মানুষের মতো হয়ে পড়েছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীরা। তাদের জন্য পোলাও-কোরমা এনে দিলেন আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ! তামাম চলচ্চিত্র দুনিয়ার তীর্থভূমি কান উৎসবে লাল-সবুজ পতাকা উড়তে যাচ্ছে এই তরুণের হাত ধরে। মর্যাদাসম্পন্ন আয়োজনটির ৭৪ম আসরের অফিসিয়াল সিলেকশনে জায়গা পেয়েছে তার দ্বিতীয় ছবি ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। শুধু চলচ্চিত্র শিল্পের জন্যই নয়, বাংলাদেশের জন্য এটি বিরাট অর্জন। প্রথমবার বাংলাদেশের কোনো পরিচালক এই সম্মান বয়ে আনলেন। পৃথিবীর স্বনামধন্য সংবাদমাধ্যমগুলোতে এখন তার ছবির নাম বয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশের নামও লেখা হচ্ছে। তাই ছবিটি হয়ে গেছে সবার! পুরো ব্যাপারটাতে যেন ছড়িয়ে আছে ঈদের আমেজ!
এতদিন বাংলাদেশের ছবির দৌড় ছিলো ঘুরেফিরে বিভিন্ন দেশের অলিগলির কিছু উৎসব। কালেভদ্রে সান্ত্বনা হিসেবে মোটামুটি আলোচিত দুই-একটা উৎসবে জায়গা পেয়েছেন এখানকার নির্মাতারা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের আহামরি অর্জন বলতে কেবল ছিলো ২০০২ সালের কানে তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’র ফিপরেস্কি পুরস্কার জয়। কানের আঁ সার্তে রিগার বিভাগে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের জায়গা পাওয়ার মধ্য দিয়ে সব অতৃপ্তি ঘুচে গেলো। তাই তাকে টুপিখোলা অভিনন্দন জানাচ্ছেন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন তিনি।
কান উৎসবের দুই আয়োজক থিয়েরি ফ্রেমো ও পিয়েরে লেসকিউর।
‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। দেশের নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীরা অভিনন্দনে সিক্ত করছেন তাকে। ইতিহাসের পাতায় যে ঢুকে গেছেন তিনি! কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে স্থান পাওয়া প্রথম বাংলাদেশি ছবির নায়িকা হিসেবে বারবার উচ্চারিত হবে তার নাম।
‘জালালের গল্প’র পরিচালক আবু শাহেদ ইমন মনে করেন, কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সাদসহ ছবিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘সিনেমার পেছনে লেগে থাকা ও ক্রমাগত ধ্যান-সততা-নিষ্ঠা নিয়ে বানিয়ে যাওয়ার পুরস্কার এটি।’
আবু শাহেদ ইমনের বিশ্বাস, কান উৎসব স্বীকৃত ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইটে ২০০২ সালে ‘মাটির ময়না’ নির্বাচিত হওয়ার প্রায় ১৯ বছর পর আঁ সার্তে রিগারে বাংলাদেশি ছবির অন্তর্ভুক্তি গল্পে, বিষয়ে ও বৈচিত্র্যে নতুনমাত্রা ও আশা জোগাবে। তার মন্তব্য, “বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প, ওটিটি’র নীতিনির্ধারক বা টিভিগুলো যখন ক্রমাগত ভুল পথে হাঁটছে, তখন ‘সঠিক কী হওয়া উচিত’ উদাহরণ নিয়ে বুক ফুলিয়ে সবার সামনে এলো এই সুসংবাদ।”
তারেক মাসুদের সহকারী হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন প্রসূন রহমান। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের সিনেমার জন্য দারুণ খবর। এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল ৫৫তম কান উৎসবে ডিরেক্টর’স ফোর্টনাইট বিভাগে ‘মাটির ময়না’র অন্তর্ভুক্তি ও পুরস্কার প্রাপ্তির পর। অনেক উদ্যোগ, অনেক সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্র নির্মিতও হয়ে আসছে। গ্লোবাল অডিয়েন্সের কাছে নিজেদের গল্প, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল কাজ নিয়ে পৌঁছাতে পারার আনন্দ যে কত সহজে ব্যক্তি নির্মাতা, কলাকুশলী কিংবা প্রযোজনা দলকে ছাড়িয়ে দেশের সবার হয়ে ওঠে, তা এরকম সময় এলে বুঝতে পারা যায়। ভাষা ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সৃজনশীল চলচ্চিত্র উদযাপিত হয় বিশ্বজুড়ে। জীবন যতদিন থাকবে সৃজনশীলতার চর্চাও চলবে। উদযাপনও চলবে।’
‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির কলাকুশলীরা বাংলাদেশিদের জাতি হিসেবে গর্বিত করেছেন— বেশিরভাগ নির্মাতা এসব অনুভূতি ভাগাভাগি করেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিনেতা তারিক আনাম খান, জিয়াউল ফারুক অপূর্ব, নির্মাতা শিহাব শাহীন, গোলাম সোহরাব দোদুল, মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ। তারিক আনাম খান মনে করেন, এটাই শুরু। বাঁধনকে উদ্দেশ করে তার মন্তব্য, ‘তোমার অর্জনে খুব খুশি হয়েছি।’
কানের সম্মানজনক লোগো সংবলিত ছবিটির প্রচারণামূলক পোস্টার কেউ কেউ ফেসবুক প্রোফাইল ও কভার পিকচার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। সবাই মনে করছেন, বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জন্য দারুণ একটি দিন এ বছরের ৩ জুন। বাংলাদেশের জন্য গর্ব করার মতো একটি দিন। ‘আয়নাবাজি’র চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামান লিখেছেন, ‘আজকে মোদের বড়ই সুখের দিন।’
‘শঙ্খনাদ’, ‘বাঁশি’, ‘নিরন্তর’ ছবির পরিচালক আবু সাইয়ীদের কথায়, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এটি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কান, বার্লিন, ভেনিসে স্থান না পাওয়ার দীর্ঘ বন্ধ্যাত্ব ভেঙে ফেললেন সাদ।’
‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র পর আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ বলা যায় সাফল্যের এভারেস্টে পেয়ে গেলেন নিজেকে। বুসান, মস্কো উৎসবে নজরকাড়া মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, ‘সাদ আমাদের পরের প্রজন্মের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা যাকে আমার খুব ভালো লাগে।’
‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবির পরিচালক দীপঙ্কর দীপনের দৃষ্টিতে ‘সাম্প্রতিক কালের বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় সুসংসবাদ এটি। তার একটি স্ট্যাটাসটা এমন, ‘আজ দিনটা ছিল খুব আনন্দের দিন। আমাদের হাতে দেশের ক্ষমতা থাকলে এই আনন্দে একদিন সাধারণ ছুটি দিয়ে দিতাম। আনন্দে আজ সারাদিন একাধিক ফেসবুক পোস্ট করেছি। বাংলাদেশি সিনেমাকে যে সম্মান দিয়েছে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, তা আকাশের মতো বিশাল।”
দীপঙ্কর দীপনের আশা— এই দৃষ্টান্তকে সামনে রেখে তৈরি হবে বাংলাদেশের একটি সিনেমা প্রজন্ম, যারা মননশীল ছবি বানাবে, গভীর জীবনবোধের বানাবে, স্থানীয় ছবি বানাবে, বিদেশের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তার মন্তব্য, ‘মননশীল চলচ্চিত্রের জগতে যে সিনেমা যত বেশি স্থানীয়, তা তত বেশি আন্তর্জাতিক। আমাদের আধুনিক বাণিজ্যিক ছবি যতটা দরকার, ততটাই দরকার মননশীল সিনেমা। এরকম একাধিক ধারা মিলেই চলচ্চিত্র শিল্প। সব ধারায় ফুল ফুটুক, বাংলাদেশি সিনেমার সফলতার ফুল।’
কানের অফিসিয়াল সিলেকশনে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সংক্রান্ত অসাধারণ খবরের লিংক এবং কানের লোগো সংবলিত প্রচারণামূলক পোস্টার শেয়ার করেছেন বাঁধন। এগুলোর মন্তব্যের ঘরে তাকে অভিনন্দনে সিক্ত করেছেন বিনোদন অঙ্গনের বাসিন্দারা।
অভিনেত্রীদের মধ্যে জয়া আহসান লিখেছেন, ‘অভিনন্দন ছবিটির কলাকুশলীদের এবং অবশ্যই আজমেরী হককে।’
জ্যোতিকা জ্যোতি রসিকতা মেখে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘এবার কী হবেরে বাঁধন!’
অপি করিম উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য একটি দারুণ খবর। সাদ ও তার দলবলকে অভিনন্দন ও কুর্নিশ জানিয়েছেন তিনি। আর বাঁধনকে বলেছেন, ‘এগিয়ে চলো প্রিয়।’
অপর্ণা ঘোষ লিখেছেন, ‘আমাদের জন্য কী বিরাট ব্যাপার! অভিনন্দন বাঁধনকে, তুমি আমাদের গর্ব।’ তার স্ট্যাটাসের মন্তব্যের ঘরে বাঁধনকে অভিনন্দন জানান দুই বর্ষীয়ান অভিনেত্রী মনিরা আক্তার মিঠু ও শিল্পী সরকার অপু।
বাঁধনকে উদ্দেশ করে কাজী নওশাবা আহমেদ বলেন, ‘তোমাকে নিয়ে গর্ব হয়। আলো ছড়াতে থাকো, আরও এগিয়ে যাও!’
বাঁধনকে ভালোবাসা, শুভকামনা, স্যালুট ও অভিনন্দন জানিয়েছেন পূর্ণিমা, তারিন, নুসরাত ফারিয়া, রাফিয়াত রশিদ মিথিলা, সুনেরাহ বিনতে কামাল, সাদিয়া জাহান প্রভা, নাজিফা তুষি, নাজিয়া হক অর্ষা, কুসুম সিকদার, নাদিয়া আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, ইপশিতা শবনম শ্রাবন্তী, রিচি সোলায়মান, রুমানা রশিদ ঈশিতা, তানভীন সুইটি, দীপা খন্দকার, শ্রাবস্তী তিন্নি, মোজেজা আশরাফ মোনালিসা, নাজনীন হাসান চুমকি, আইরিন সুলতানা, রোকেয়া প্রাচী, মৌসুমী নাগ, সুষমা সরকার, তানজিকা আমিন, শানারেই দেবী শানু, সাদিকা স্বর্ণা, গোলাম ফরিদা ছন্দা, হাসিন রওশন, উপস্থাপক মাসুমা রহমান নাবিলা, শ্রাবণ্য তৌহিদা, পিয়া জান্নাতুল, নীল হুরেরজাহান, নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী, আকরাম খান, গাজী শুভ্র, অনম বিশ্বাস, তানিম রহমান অংশু, শাফায়েত মনসুর রানা, আরিক আনাম খান, হৃদি হক, শাহনেওয়াজ কাকলী, নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামূল, নিয়াজ মাহবুব, খিজির হায়াত খান, ইফতেখার চৌধুরী, নিয়ামূল মুক্তা, সংগীতশিল্পী ইমন সাহা, আঁখি আলমগীর, আলিফ আলাউদ্দিন, এলিটা করিম, খৈয়াম সানু সন্ধি, সাব্বির জামান, ফাতেমা জাহাঙ্গীর জুলি, নাট্যকার ফারিয়া হোসেন, রুম্মান রশিদ খান, নৃত্যশিল্পী সামিনা হোসেন প্রেমা।
অভিনেতা সিয়াম আহমেদ ফেসবুক প্রোফাইল পিকচার হিসেবে রেখেছেন রেহানা মরিয়ম নূর-এর পোস্টার। লাল-সবুজ পতাকার ইমোজি জুড়ে দিয়ে স্ট্যাটাসে সাদকে উদ্দেশ করে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের গর্বিত করেছেন আপনি।’
এছাড়া বাঁধনের বিভিন্ন পোস্টের মন্তব্যের ঘরে অভিনন্দন জানিয়েছেন অভিনেতা ইরেশ যাকের, ইমন, শতাব্দী ওয়াদুদ, আদনান ফারুক হিল্লোল, মাজনুন মিজান, মুকিত জাকারিয়া, জাহিদ হোসেন শোভন।
কান উৎসবে প্রতিযোগিতা বিভাগ ছাড়া আঁ সার্তে রিগার বিভাগে নির্বাচিত ছবিগুলোর জন্য থাকে পুরস্কার। এবার ১৭টি দেশের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। ফলে বাংলাদেশের জন্য আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ ও বাঁধন আরও আনন্দ বয়ে আনার সুযোগ পাচ্ছেন। আগামী ৬ জুলাই কান উৎসবের পর্দা উঠবে।
কানের ইতিহাসে প্রথমবার অফিসিয়াল সিলেকশনে স্থান পাওয়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য বিরাট অর্জন। এর মাধ্যমে সত্যিকার অর্থেই চলচ্চিত্র শিল্প অনেক বড় ধাপ এগোলো। একইসঙ্গে দেশের তরুণ নির্মাতাদের জন্য খুলে গেলো অপার সম্ভাবনার দুয়ার। বাংলাদেশের প্রতি চলচ্চিত্র দুনিয়ার বাড়তি নজর থাকবে। আমাদের সিনেমার জন্য এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ নামটি যে মনে রাখতেই হবে!