বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের কারণে রোববারও সারা দেশে বৃষ্টি হয়েছে। কখনো মুষলধারে আবার কখনো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ে। জরুরি না হলে মানুষ ঘর থেকে বের হননি। সড়কে যানবাহন চলাচলও ছিল তুলনামূলক কম। হাতে কাজ না থাকায় বিপাকে পড়েন নিম্ন আয়ের মানুষ। টানা বৃষ্টির কারণে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন করে আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা। বরিশাল, শরীয়তপুর, যশোর ও বাগেরহাট শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। তলিয়ে গেছে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক।
কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকেছে। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হয়েছেন এসব নগরের বাসিন্দারা। লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও নাটোরের বাগাতিপাড়ায় ঝড়ো বাতাসে বৈদ্যুতিক লাইন-খুঁটি বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ভোলা ও হাতিয়ায় সাগরে মাছ ধরার ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হওয়া ৭০ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল থেকে আরও এক লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, লাশটি ট্রলার ডুবির ঘটনায় নিখোঁজ জেলের।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সাগরে সৃষ্টি হওয়া স্থল নিম্নচাপ ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়ছে। ফলে সোমবার থেকে বৃষ্টি অনেকটা কমে যেতে পারে। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
বরিশাল: নগরীর নিম্নাঞ্চলসহ অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। অধিকাংশ প্রধান সড়ক ও অলিগলি তলিয়ে যাওয়ায় পথচারীসহ যানচালকরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। তবে নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সরেজমিন দেখা যায়, নগরীর কলেজ অ্যাভিনিউ, নবগ্রাম রোড, রূপাতলী হাউজিং, বেলতলা, বৌবাজার, রসুলপুর, মোহাম্মদপুর, চরআবদানীসহ বরিশাল সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
এছাড়া বগুড়া রোড, পলাশপুর, হাটখোলা সড়ক, অক্সফোর্ড মিশন রোড, বিএম স্কুল লেন, কাউনিয়া হাউজিং সংলগ্ন সড়ক ও থানার গলি, শ্রীনাথ চ্যাটার্জী লেন, টিয়াখালি সড়ক, প্যারারা রোড, নিউ সার্কুলার রোড, সাগরদী জিয়ানগরসহ বেশ কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল ও সড়কে পানি উঠেছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা চরম দুর্ভোগে দিন পার করছেন।
শরীয়তপুর: জেলা শহরের নিরালা আবাসিক এলাকা, শান্তি নগর, হরিসভা, কলেজসংলগ্ন এলাকা, বাঘিয়া, বাসস্ট্যান্ড, দার্সাত্তা এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পালং উত্তর বাজার, কোতোয়াল বাড়ি এলাকাসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পানিতে অনেকের মাছের ঘের ভেসে গেছে। শুক্রবার গভীর রাত থেকে টানা বৃষ্টিতে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সিভিল সার্জন অফিস এলাকা, শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল মোড়, জেলা ডাকঘরের সামনে, শরীয়তপুর পৌরসভার পেছনে, সাবনুর মাকের্ট, চরপালং এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতেও পানি উঠেছে। পানিবন্দি পরিবারগুলো দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। শহরের রিকশাচালক বাবুল বেপারী বলেন, ৩ দিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। রাস্তায় গর্ত হয়ে গেছে। পানিতে পাকা সড়কে গর্ত দেখা যায় না। তারপরও পেটের তাগিদে রিকশা নিয়ে বের হয়েছি।
চাটখিল (নোয়াখালী): চাটখিল উপজেলায় আবারও বন্যা দেখা দিয়েছে। ১৬৮টি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে বৃহস্পতিবার অধিকাংশ বানভাসি মানুষ নিজ নিজ বাড়ি-ঘরে চলে যায়। টানা বৃষ্টির কারণে শনিবার বিকালে অনেক পরিবারকে আবারও আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটতে দেখা গেছে। ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন জানান, রোববার সকাল পর্যন্ত ৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে নতুন করে ১১২০ জন ভানবাসি আশ্রয় নিয়েছে। বন্যার পানিতে গ্রামীন রাস্তা-ঘাটের ৯০ ভাগই পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
বাগেরহাট: ২৪ ঘণ্টার বৃষ্টিতে বাগেরহাট পৌর শহরের বেশিরভাগ এলাকার অলিগলি পানিতে তলিয়ে গেছে। সরেজমিন দেখা যায়, শহরের খানজাহান আলী রোড, রেল রোড, সাধনার মোড়, শালতলা, পিটিআই মোড়, খারদার স্কুল রোড, জেলা হাসপাতাল মোড়, জেলা ডাকঘরের সামনে, বাসাবাটি, মিঠাপুকুরপাড় মোড়, পৌরসভার পাশে, জাহানাবাদ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সড়ক, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের পেছনসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে নিমজ্জিত। অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়িতে পানি উঠে গেছে। টানা বৃষ্টিতে জেলার মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা, রামপাল ও কচুয়ার নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হয়েছে। অনেকের মাছের ঘের ভেসে গেছে। এদিকে জলাবদ্ধতার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর): কমলনগর ও রামগতি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা আবারও পানিতে তলিয়ে গেছে। কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের বাদামতলির মো. আফজল হোসেন বলেন, বন্যার পানি কিছুটা নামলেও বৃষ্টির কারণে চরকাদিরা ইউনিয়নে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের আজাননগর এলাকার নুরুল ইসলাম বলেন, প্রায় দুমাস আমরা পানিবন্দি। পানি কিছুটা কমলেও তিন দিনের বৃষ্টিতে ফের বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে।
যশোর: দুদিনে জেলায় ১৫৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারি বর্ষণে তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল। ভেসে গেছে মাছের ঘের, পুকুর জলাশয়। মাঠের পর মাঠ ফসল পানির নিচে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে শহরের বেজপাড়া, টিবি ক্লিনিকপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়া, শংকরপুর, মিশনপাড়া, উপশহর, চাঁচড়া, কারবালা, এমএম কলেজ এলাকা, নাজিরশংকরপুর, বকচর, আবরপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকার প্রায় ৩০টি সড়ক। এর মধ্যে শংকরপুর, বেজপাড়া, খড়কি, কারবালা, রেলগেট পশ্চিমপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়ার অনেক বাড়ি-ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার ড্রেন ছাপিয়ে উপচে পড়া পানি সড়ক পার হয়ে ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোশাব্বির হোসাইন বলেন, টানা ভারি বর্ষণে উপজেলার প্রায় এক হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমির আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। একই সাথে ৪০০ হেক্টর জমির সবজি ও মরিচের ক্ষতি হয়েছে।
বেগমগঞ্জ (নোয়াখালী): জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ফের বাড়িতে পানি উঠায় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে বাড়ছে মানুষ। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ো বাতাসে ভেঙে পড়েছে গাছ-পালা। কয়েকটি স্থানে ঘর ভেঙে পড়ার খবরও পাওয়া গেছে। বিদ্যুতের লাইনে গাছ ভেঙে পড়ায় এবং খুঁটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জেলায় বিদ্যুৎহীন প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ। একটানা বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিপর্যয়। সরেজমিন দেখা গেছে, কবিরহাট, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল উপজেলার বেশিরভাগ এলাকায় স্থায়ী হয়েছে জলাবদ্ধতা। শুক্রবার সকাল পর্যন্ত এসব উপজেলার বেশিরভাগ ইউনিয়নের বিভিন্ন বাড়ির উঠান ও সড়কে হাঁটু পরিমান পানি ছিল।
রায়পুর (লক্ষ্মীপুর): ঝড়ো বাতাসে বৈদ্যুতিক লাইন ও খুঁটি বিধ্বস্ত হওয়ায় রায়পুরসহ জেলার অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। ফলে অন্ধকারে রয়েছে অন্তত পাঁচ উপজেলার চার লাখ গ্রাহক। রায়পুর পৌরসভার কাঞ্চনপুরের গৃহবধূ তাসলিমা খানম জানান, তিনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহক। গত দুদিন ধরে তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। এতে খাবার ও পর্যাপ্ত পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
বাগাতিপাড়া (নাটোর): টানা দুদিনের বৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষ বিপাকে পড়েছেন। তারা কাজে বের হতে পারছেন না। কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে বের হলেও কাঙ্ক্ষিত যাত্রী পাচ্ছেন না। এদিকে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শনিবার সকাল ৭টা থেকে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে পুরো উপজেলা। কোথাও কোথাও সন্ধ্যা ৬টায় সংযোগ পেলেও উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা রাত ১১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎহীন ছিল।
কক্সবাজার: কক্সবাজার সমুদ্র উপক‚লে আরও একজনের লাশ ভেসে এসেছে। রোববার সকালে শহরের পশ্চিম কুতুবদিয়া পাড়া সমুদ্র উপকূলে লাশটি ভেসে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে ট্রলারসহ নিখোঁজ জেলেদের একজনের লাশ এটি।
টেকেরহাট (মাদারীপুর): শহরের ফুড অফিসের মোড়, নিরাময় হাসপাতাল রোড, কালিবাড়ি সড়ক, ইউআই স্কুল সড়ক, বাতামতলা রোড, শহীদ মানিক সড়ক, শহীদ বাচ্চু সড়ক, পাবলিক লাইব্রেরি রোড, তরমুগরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকার সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে।
হাতিয়া (নোয়াখালী): হাতিয়ায় ঝড়ো হাওয়ায় ডুবে যাওয়া মাছ ধরার ট্রলারের ২২ জেলেকে রোববার জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। জাহাজমারা আমতলী ঘাটের মৎস্য ব্যবসায়ী ও বোট মালিক লুৎফুল্লাহিল মজিদ নিশান মিয়া এ তথ্য জানিয়েছেন।
ভোলা, চরফ্যাশন ও মনপুরা: দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এদিকে চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার সাগর মোহনায় ডুবে যাওয়া ৫টি ফিশিংবোটের নিখোঁজ ৪৯ জেলে রোববার ভোরে বাড়ি ফিরেছে। তাদের অপরাপর জেলে নৌকার সাহায্যে উদ্ধার করা হয়।