অর্থনীতি

স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে প্রবাসী আয়

বৈদেশিক বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে, তবে কৃষিতে উৎপাদন সন্তোষজনক হলেও তার প্রভাব নেই বাজারে। দেশি-বিদেশি নানা প্রভাবকের কারণে মূল্যস্ফীতি লাগাম ছাড়া।

যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে মানুষের সঞ্চয়ে। একমাত্র প্রবাসী আয়ই পথ দেখাচ্ছে—ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রেমিট্যান্স। এই সময়ে প্রবাসগামী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, বিদায়ী মার্চ মাসে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০১ কোটি ডলার। টাকার অংকে যা ২১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৭ টাকা ধরে)। একই সময়ে প্রবাসে গেছেন এক লাখ ৯ হাজার ৫০২ জন। প্রবাসে যাওয়া জনশক্তি বা দেশে আসা প্রবাসী আয় দুটোই বিএমইটি বা ব্যাংকিং খাতের মতো দুটো ফর্মাল চ্যানেলে। এর বাইরে ইনফর্মাল চ্যানেলে অর্থ যেমন এসেছে; বিপুলসংখ্যক মানুষও সরকারের হিসাবের বাইরে বিভিন্নভাবে কাজের সন্ধানে বিদেশে গেছেন। যা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের হিসাবে নেই।

প্রবাসে যাওয়া জনশিক্ত ও প্রবাস থেকে পাঠানো বৈদেশিক আয় দুটোই সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বেশি। অর্থনীতির প্রধান তিন ভিত্তির অন্যতম প্রধান ভিত্তি প্রবাসী আয়ের এই ইতিবাচক খবরে স্বস্তির বার্তা দিচ্ছে।

চলতি ২০২৩ সালের তিন মাস জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রবাসী আয় এসেছে যথাক্রমে ১৯৫ কোটি ৮৯ ডলার, ১৫৬ কোটি ৫ লাখ ডলার ও ২১০ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। অর্থ বছরের হিসাবে ২০২২-২৩ এর জুলাই-মার্চ ৯ মাসে প্রবাসী আয় এসেছে এক হাজার ৬০৩ কোটি তিন লাখ ডলার। আগের ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসেছিল দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার এবং করোনা মহামারির বছর ২০২০-২১ অর্থ বছরে এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।

করোনা মহামারিতে প্রবাসী আয় বেড়ে যায়। পরের বছর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী আয় কমতে থাকে। এ সময় প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে সরকার বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিলে প্রবাসী আয় ঘুরে দাঁড়াতে থাকে। গত চার মাসে প্রবাসী আয় বাড়তে থাকে। সর্বশেষ মার্চ মাসে অব্যাহত এ ইতিবাচক ধারার প্রতিফলন দেখা যায়।

করোনা পরবর্তী প্রবাসী আয়ের মতো প্রবাসে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। করোনা মহামারির মধ্যে অর্থনীতি সংকুচিত হয়, করোনা পরবর্তী বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়। চাহিদা বাড়ে বিদেশি জনশিক্তর। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের জনশক্তির যোগানদাতা। এসব দেশের উন্নয়নে বাংলাদেশের অদক্ষ-আধা দক্ষ জনশক্তি দীর্ঘদিন ধরেই অবদান রাখছে। করোনা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশিদের প্রবাসে যাওয়ার হারও বেড়ে যায়। বিএমইটি তথ্যতে বিষয়টি ফুটে ওঠে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রবাসে যান ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। এটা একক বছর হিসাবে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের প্রবাসে যাওয়া। আগের ২০২১ সালে যায় ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯, করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত বছর ২০২০ সালে প্রবাসে যায় ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জন। আগের বছর ২০১৯ সালে প্রবাসে গিয়েছিলেন ৭ লাখ ১৫৯ জন।

প্রবাসীদের আয় বৃদ্ধিতে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার একরেটে যাওয়াকে গুরুত্ব দেন ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, এক রেট না হওয়ার কারণে বাজারে কিছুটা অস্থির হওয়ার সুযোগ থাকে। এই অস্থিরতা রোধে উদ্যোগ নিতে হয়েছে।

প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলো কার্যকর করতে হবে। পর্যবেক্ষণ জোরদার করার তাগিদ দেন তিনি।

খাদ্য উৎপাদনে নানা প্রচেষ্টার ফলে দেশের পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু বাড়তি উৎপাদন ব্যয়ের কারণে খাদ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। বাড়ছে দানাদার খাদ্যের বাইরে অন্যান্য খাদ্যের দামও। সর্বশেষ মার্চ মাসের মূল্যস্ফীতি উঠেছে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে । মূল্যস্ফীতির আঘাত মানুষের সঞ্চয়ে লেগেছে। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে বাড়তি ব্যয় মেটাচ্ছে। সঞ্চয়পত্র কেনার বিপরীতে মানুষ বেশি বেশি ভাঙছে।

রপ্তানি আয় এখনো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে। চলতি অর্থ বছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৪১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আগের ফেব্রুয়ারি মারে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তথ্য বলছে, রপ্তানি আয়ে এখনো ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলেও তা কমে আসছে।

এ সময়ে ডলারের চাহিদা কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু কার্যত কোনো কাজে আসছে না। চলতি অর্থ বছর ২০২২-২৩ এর প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এক হাজার ৩৮২ কোটি ৮০ লাখ (১৩ দশমিক ৮২ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থ বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ৪ হাজার ৮৭৯ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৪৯৬ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য।

একমাত্র প্রবাসী আয়ই ইতিবাচক ধারায় আছে। অবশ্য এর জন্য সরকারকে নানা রকম উদ্যোগ নিতে হয়েছে। প্রবাসী আয় বাড়াতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেগুলো—বৈধ পথে প্রবাসী আয় পাঠানোর বিপরীতে নগদ প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ করা, প্রবাসীদের সিআইপি সম্মাননা দেওয়া, প্রবাসী আয় বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজ করা, অনিবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা দেওয়া, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা ও রেমিট্যান্স পাঠাতে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে।

এছাড়া সেবার বিনিময়ে দেশে প্রবাসী আয় আনার ক্ষেত্রে ফরম ‘সি’ পূরণ করার শর্ত শিথিল করার ব্যবস্থা করা হয়। ঘোষণা ছাড়াই সেবাখাতের উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকদের ২০ হাজার মার্কিন ডলার দেশীয় মুদ্রা দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এসব উদ্যোগের ফলে প্রবাসী আয় যেমন বাড়ছে। যে হারে প্রবাসে যাওয়া মানুষের সংখ্য বাড়ছে তাতে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ধারাকে আরও টেকসই করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *