খেলাধুলা

নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ঐতিহাসিক ওয়ানডে জয় টাইগারদের

চার পেসারের আগুন ঝড়ানো বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মত ওয়ানডে ম্যাচ জিতে হোয়াইটওয়াশ এড়ালো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আজ সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ৯ উইকেটে হারিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে। সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হেরে হোয়াইটওয়াশের মুখে পড়েছিলো বাংলাদেশ। ঐতিহাসিক এই জয়ে নিউজিল্যান্ডের কাছে হোয়াইটওয়াশ এড়াতে সক্ষম হলো টাইগাররা। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-১ ব্যবধানে হারলো শান্ত-লিটনরা।

নিউজিল্যান্ডের মাটিতে আগের ১৮ ম্যাচেই হেরেছিলো বাংলাদেশ। হারের বৃত্ত ভেঙ্গে ১৯তম ম্যাচে এসে প্রথম জয়ের নজির গড়লো টাইগাররা। সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৫তম ওয়ানডেতে ১১তম জয় বাংলাদেশের।

এ ম্যাচে টস জিতে প্রথমে বোলিং করতে নেমে নিউজিল্যান্ডকে ৯৮ রানে অলআউট করে বাংলাদেশের পেসাররা। চার পেসার শরিফুল ইসলাম-তানজিম হাসান সাকিব ও সৌম্য সরকার ৩টি করে এবং মুস্তাফিজুর রহমান ১ উইকেট নেন। জবাবে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তর হাফ-সেঞ্চুরিতে ২০৯ বল বাকী রেখে ম্যাচ জিতে নেয় বাংলাদেশ। ৫১ রানে অপরাজিত থাকেন শান্ত।

হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর মিশনে নেপিয়ারে টস জিতে প্রথমে বোলিং করার সিদ্বান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক শান্ত।

চতুর্থ ওভারের পঞ্চম বলে বাংলাদেশকে প্রথম উইকেট উপহার দেন পেসার তানজিম। উইকেটের পেছনে মুশফিকুর রহিমকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ৮ রান করা রাচিন রবীন্দ্র। শুরুতেই উইকেট হারানোর পর সাবধানে খেলতে শুরু করেন আরেক ওপেনার উইল ইয়ং ও তিন নম্বরে নামা হেনরি নিকোলস। এই জুটিকে ২০ বলের বেশি একত্রে এগোতে দেননি তানজিম। পুল করতে গিয়ে মিড অনে শান্তকে ক্যাচ দিয়ে তানজিমের দ্বিতীয় শিকার হন ১ রান করা হেনরি নিকোলস।

২২ রানে ২ উইকেট হারানোর পর জুটি গড়ার চেষ্টা করেন ইয়ং ও অধিনায়ক টম লাথাম। বাংলাদেশ বোলারদের সামনে প্রতিরোধ গড়ে ১৫তম ওভারে দলের রান ৫০ পার করেন তারা।

১৭তম ওভারে আবারো আক্রমনে আসেন প্রথম স্পেলে ৪ ওভারে ১৬ রানে উইকেটশূন্য থাকা শরিফুলকে। ফিরেই টানা তিন ওভারে ৩ উইকেট শিকার করেন শরিফুল।

৩৪ বলে ২১ রান করা লাথামকে বোল্ড আউটে বাংলাদেশকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন শরিফুল।  ভেঙ্গে যায়র লঅথাম- ইয়ংয়ের ৫৫ বলে ৩৬ রানের জুটি।

লাথামের পর ইয়ংয়ের প্রতিরোধও ভাঙ্গেন শরিফুল। অফ স্টাম্পের বাইরের বল মারতে গিয়ে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে মেহেদি হাসান মিরাজকে ক্যাচ দেন ইয়ং। ৩টি চারে ৪৩ বলে ২৬ রান করেন প্রথম দুই ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে ভোগানো ইয়ং। প্রথম দুই ম্যাচে যথাক্রমে- ১০৫ ও ৮৯ রান করেছিলেন তিনি।

ইয়ংকে শিকার করে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে বাংলাদেশের ১৪তম  বোলার হিসেবে ৫০তম উইকেট পূর্ণ করেন শরিফুল।

ইয়ংয়ের পর নতুন ব্যাটার মার্ক চাপম্যানকে বেশিক্ষণ ক্রিজে থাকতে দেননি শরিফুল। দারুন এক ডেলিভারিতে ২ রান করা চাপম্যানকে বোল্ড করেন তিনি। শরিফুল শো’তে ৬৩ রানে পঞ্চম উইকেট হারিয়ে মহাবিপদে পড়ে নিউজিল্যান্ড।

দ্বিতীয় স্পেলে ৩ ওভারে ৬ রানে ৩ উইকেট নেন শরিফুল। এমন দুর্দান্ত বোলিংয়ের পরও শরিফুলকে সরিয়ে, প্রথম স্পেলে ৫ ওভারে ৯ রানে দুই উইকেট নেওয়া তানজিমকে আক্রমনে ফিরিয়ে আনেন শান্ত। ২৩তম ওভারে ফিরেই প্রথম ডেলিভারিতেই উইকেটরক্ষক টম ব্লান্ডেলকে ৪ রানে বিদায় করেন তানজিম।

শরিফুল-তানজিমের আগুন বোলিংয়ে ৭০ রানে ষষ্ঠ উইকেট হারিয়ে খাদের মধ্যে পড়ে যায় নিউজিল্যান্ড। দু’পেসারই সমান ৩টি করে উইকেট নেন।

শরিফুল-তানজিদের সাথে উইকেট শিকারে মেতে উঠেন সৌম্য। প্রথম ৩ ওভারে উইকেট না পেলেও, পরের তিন ওভারে ৩ উইকেট শিকার করেন  সৌম্য। জশ ক্লার্কসনকে ১৬ রানে বোল্ড, ব্যক্তিগত ৪ রানে এডাম মিলনের উইকেট উপড়ে ফেলা এবং আদিত্য অশোককে ১০ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন সৌম্য।

সৌম্যর তোপে ৯৭ রানে ৯ উইকেট হারায় নিউজিল্যান্ড। শেষ ব্যাটার হিসেবে উইলিয়াম ও’রুর্ককে ১ রানে বোল্ড করে কিউইদের ৩১ দশমিক ৪ ওভারে ৯৮ রানে অলআউট করে দেন মুস্তাফিজ। ওয়ানডে ক্রিকেটে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডকে  অলআউট করলো বাংলাদেশ। এবারই প্রথম বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১শর নীচে গুটিয়ে গেল কিউইরা। আর দেশের মাটিতে আজকের আগে বাংলাদেশের বিপক্ষে একবারই অলআউট হয়েছিলো নিউজিল্যান্ড। ২০১৬ সালে নেলসনে ২৫১ রানে সব উইকেট হারিয়েছিলো কিউইরা।

এ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের পতন হওয়া সবগুলো উইকেটই নিয়েছেন চার পেসার। শরিফুল ২২,  তানজিম ১৪ ও সৌম্য ১৮ রানে ৩টি করে উইকেট নেন। ৩৬ রানে ১ উইকেট শিকার করেন মুস্তাফিজ। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার ওয়ানডেতে প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটই নিলেন বাংলাদেশের পেসাররা। এর আগে এ বছরের মার্চে সিলেটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ১০ উইকেট শিকার করেছিলেন হাসান মাহমুদ-তাসকিন আহমেদ ও এবাদত হোসেনরা। ঐ ম্যাচে হাসান ৫টি, তাসকিন ৩টি ও এবাদত ২ উইকেট শিকার করেছিলেন।

৯৯ রানের সহজ টার্গেটে খেলতে নেমে সাবধানী শুরু করেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার সৌম্য সরকার ও এনামুল হক বিজয় । প্রথম ২৯ বলে ১৫ রান তুলেন তারা। এরপর চোখের সমস্যা নিয়ে মাঠ ছাড়েন আগের ম্যাচে ১৬৯ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলা সৌম্য। ১৬ বলে ৪ রান করে আহত অবসর হন তিনি।

পঞ্চম ওভারে সৌম্য ফেরার পর মারমুখী ব্যাটিং শুরু  করেন বিজয় ও তিন নম্বরে নামা শান্ত। ষষ্ঠ ও দশম ওভারে ১৪ রান করে, ১১তম ওভারে ১৭ রান নেন তারা। ১৩তম ওভারের শেষ বলে দলীয় ৮৪ রানে আউট হন ৭টি চারে ৩৩ বলে ৩৭ রান করা বিজয় । দ্বিতীয় উইকেটে ৫০ বলে ৬৯ রান যোগ করেন বিজয়-শান্ত।

এরপর লিটন দাসকে নিয়ে অবিচ্ছিন্ন ১৫ রান তুলে ২০৯ বল বাকি থাকতে রেখে বাংলাদেশের জয় নিশ্চিত করেন শান্ত । নিজেদের ওয়ানডেতে তৃতীয় সর্বোচ্চ বল বাকি  রেখে ম্যাচ জিতলো টাইগাররা।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারের অষ্টম হাফ-সেঞ্চুরি করে ৫১ রানে অপরাজিত থাকেন শান্ত। তার ৪২ বলের ইনিংসে ৮টি চার ছিলো। ১ রানে অপরাজিত থাকেন লিটন। ১৪ রানে ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছেন বাংলাদেশের তানজিম। ২২০ রান করায় সিরিজ সেরা হন নিউজিল্যান্ডের ইয়ং।

দেশের মাটিতে টানা ১৭ ম্যাচ অপরাজিত থেকে এ ম্যাচে খেলতে নেমেছিলো নিউজিল্যান্ড। এ ম্যাচ জিতলে অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ড টানা ১৮টি ম্যাচ জয়ের রেকর্ড স্পর্শ করার সুযোগ ছিলো কিউইদের। কিন্তু হতে দিলো না বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের কাছে ওয়েলিংটনে হেরেছিলো নিউজিল্যান্ড।

নেপিয়ারেই আগামী ২৭ ডিসেম্বর থেকে তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ শুরু করবে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড।

স্কোর কার্ড : (টস-বাংলাদেশ)
নিউজিল্যান্ড ইনিংস :
ইয়ং ক মিরাজ এন্ড ব শরিফুল ২৬
রবীন্দ্র ক মুশফিকুর ব তানজিম ৮
নিকোলস  ক শান্ত ব তানজিম ১
লাথাম ব শরিফুল ২১
ব্লান্ডেল ক মিরাজ ব তানজিম ৪
চ্যাপম্যান ব শরিফুল ২
ক্লার্কসন ব সৌম্য ১৬
মিলনে ব সৌম্য ৪
অশোক ক মুশফিক ব সৌম্য ১০
ডাফি অপরাজিত ১
ও’রউক ব মুস্তাফিজ ১
অতিরিক্ত (বা-১, ও-৩) ৪
মোট (অলআউট, ৩১.৪ ওভার) ৯৮
উইকেট পতন : ১-১৬ (রবীন্দ্র), ২-২২ (নিকোলস), ৩-৫৮ (লাথাম), ৪-৬১ (ইয়ং), ৫-৬৩ (চ্যাপম্যান), ৬-৭০ (ব্লান্ডেল), ৭-৮৫ (ক্লার্কসন), ৮-৮৬ (মিলনে), ৯-৯৭ (অশোক), ১০-৯৮ (ও’রউক)।

বাংলাদেশ বোলিং :

শরিফুল : ৭-০-২২-৩,
তানজিম : ৭-২-১৪-৩,
মুস্তাফিজ : ৭.৪-০-৩৬-১ (ও-২),
সৌম্য : ৬-১-১৮-৩ (ও-১),
মিরাজ : ১-০-৩-০,
রিশাদ : ৩-০-৪-০।
বাংলাদেশ ইনিংস :
সৌম্য আহত অবসর ৪
আনামুল ক ব্লান্ডেল ব ও’রউক ৩৭
শান্ত অপরাাজিত ৫১
লিটন অপরাজিত ১
অতিরিক্ত (নো-২, ও-৪) ৬
মোট (১ উইকেট, ১৫.১) ৯৯

উইকেট পতন : ০-১৫ (সৌম্য, আহত অবসর), ২-৮৪ (আনামুল)।

নিউজিল্যান্ড বোলিং :

মিলনে : ৪-০-১৮-০,
ডাফি : ৫-০-২৭-০ (ও-২) (নো-২),
ক্লার্কসন: ২-০-১৯-০,
ও’রউক : ৪-০-৩৩-১ (ও-২),
অশোক : ০.১-০-২-০।

ফল : বাংলাদেশ ৯ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : তানজিম হাসান সাকিব (বাংলাদেশ)।

সিরিজ সেরা : উইল ইয়ং (নিউজিল্যান্ড)।

সিরিজ : তিন ম্যাচ সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতলো নিউজিল্যান্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *