জাতীয়

বাড়ছে অশালীন আচরণ, সংকটে বিচার বিভাগ

দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের অশোভন আচরণের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এতে বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব। এতে একরকম বৈরী পরিবেশ বিরাজ করছে সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোতে।

কোনো কোনো ঘটনা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আদালত দায়ী আইনজীবীদের তলব করে তিরস্কারসহ নানা নির্দেশনা দিয়েছেন।

এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এ ধরনের আচরণ দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশেরই নামান্তর। দেশের আইন পেশায় বহু বরেণ্য ও কীর্তিমান ব্যক্তি নিয়োজিত ছিলেন ও আছেন। কিছু উচ্ছৃঙ্খল মানুষের হঠকারিতার জন্য এ পেশাটির প্রতি মানুষের আস্থা ও শ্রদ্ধা প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যায় না। এই জন্য আইনজীবীদের মানোন্নয়নে নিয়ন্ত্রক ও তদারকি সংস্থা বার কাউন্সিলকে আরও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

দেশে গত ৬ মাসে বিচারকের সঙ্গে আইনজীবীদের অশালীন আচরণের অন্তত ২০টি ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে হট্টগোল, বিচারক ও আদালতের কর্মচারীদের গালাগাল ও অশালীন আচরণের ঘটনা ঘটে। এতে নিন্দা জানিয়েছেন দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনা চলছে। বিচারকার্যে নগ্ন হস্তক্ষেপের অভিযোগে প্রতিবাদস্বরূপ ফেসবুকে কালো রংয়ের প্রোফাইল পিকচার ব্যবহার করছেন দেশের সব বিচারক ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা। নিজেদের ছবি পালটে ‘ব্ল্যাকআউট’ করেছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী বিচারকরা। এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে বিচারকের প্রতি আইনজীবীদের আচরণ খুব খারাপ ছিল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করেছেন। এটা বিচারাধীন ব্যাপার।

দেশে এখন মানসম্মত আইনজীবী তৈরি হচ্ছে না-এমন মন্তব্য করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, আইন পেশার মান এখন নিুগামী। এর প্রধান কারণ হলো-নিয়ন্ত্রক সংস্থা বার কাউন্সিল থেকে সনদ দিতে যে যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে তার অনেকটা শিথিল করা হয়েছে।

এছাড়া গত ১০ বছরে মামলার সংখ্যা তেমন একটা বাড়েনি। যে সংখ্যক মামলা দায়ের হয়েছে, এর তিনগুণ আইনজীবী এ পেশায় এসেছেন। যার ফলে একটা অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এছাড়া বার কাউন্সিলে এখন ৪০ থেকে ৫০ হাজার ছাত্র পরীক্ষা দেন। এখানেও যোগ্যতা বিবেচনা অনেকটা শিথিল হয়ে গেছে।

একদিকে যোগ্যতা বিবেচনা শিথিল, অন্যদিকে সারা মাসের খরচের জন্য যথেষ্ট মামলা আইনজীবীরা যদি না পান, তাহলে এর প্রভাব তো পেশার মধ্যে পড়তে বাধ্য।

তিনি বলেন, এখন ৪০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ রয়েছে। বেশিরভাগ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না। মানসম্মত আইনজীবী বের হচ্ছে না। আইনজীবীদের শিক্ষার মানও নিুমুখী। সবকিছু মিলিয়ে এ পেশাতে একটা জটিল অবস্থা তৈরি হয়েছে।

আইনজীবীদের মানোন্নয়নে বার কাউন্সিলে নেতাদের আরও সময় দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, বার কাউন্সিলের অমনোযোগের কারণে আইনজীবীদের মান বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া হচ্ছে না। নেতাদের প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে পূর্ণকালীন সময় দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

অন্যদিকে বিচারকদের মানে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এখন তো বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া খুবই প্রতিযোগিতামূলক। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্ররাই সেখানে সুযোগ পান। শুধু দক্ষ বিচারক হলেই কি হবে? সারা দিন যদি অদক্ষ লোকের সঙ্গে কথা বলতে হয়-এর প্রভাব তো বারে পড়বেই।

এমন পরিস্থিতির জন্য আইনজীবীদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়াকে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, আইন ও সংবিধান অনুযায়ী বিচারক এবং আইনজীবী বিচার বিভাগের দুটি অঙ্গ। এরা পাশাপাশি সহবস্থানে থাকার কথা, কিন্তু থাকছেন না। আইনজীবী বলেন, কোনো কোনো আইনজীবী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। বিশেষ করে যারা ক্ষমতাসীন দলে থাকেন তাদের পাওয়ারটা একটু বেশি মনে হয়।

তারা মনে করেন, খুব পাওয়ারফুল (ক্ষমতাশালী), সব জায়গায় ক্ষমতা খাটাতে চান। যখন বিচারক আসামিকে জামিন দেন না, বা কোনো একটা অনিয়মের ব্যাপারে বিচারক কথা বলেন, তখন ওইসব আইনজীবী এটা সহ্য করতে পারেন না। তখনই বিপত্তি ঘটে। ক্ষমতাটা তারা বিচার বিভাগেও প্রয়োগ করতে চান।

তিনি আরও বলেন, আমার দৃষ্টিতে বার কাউন্সিল একটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আইনজীবীদের কন্ট্রোল বিশেষ করে শৃঙ্খলা, শিক্ষা, ট্রেনিং, সবকিছুর একটা কর্মসূচি থাকা দরকার। তা না হলে বিচার বিভাগের জন্য এটা মারাত্মক ক্ষতিকর। বার এবং বেঞ্চের যদি সমন্বয় না থাকে, তাহলে বিরোধ বাড়বেই, অবস্থা আরও খারাপ হবে। আর বর্তমান পরিস্থিতি বিচার বিভাগের জন্য একটা সংকট তৈরি করবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন জেলার অপ্রীতিকর ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করছেন আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউর রহমান। তিনি শনিবার বলেন, এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন। এসব ঘটনায় বার কাউন্সিলের পক্ষ থেকেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনজীবীরা আদালতকে সাহায্য করেন। আইনজীবীরা ঠিকই আছেন, কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো বার কাউন্সিলের নজরে যখনি আসছে, তখনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আইনের শাসন বাস্তবায়নে আইনজীবীরা বদ্ধপরিকর।

১ ডিসেম্বর শীতকালীন ছুটির আগে আদালতের শেষ কার্যদিবসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুকের আদালতে কয়েকজন আইনজীবী দুপুরের দিকে কয়েকটি মামলা দাখিল করেন। কিন্তু দাখিলে বিলম্ব হওয়ার কারণে বিচারক মামলাগুলো গ্রহণ করেননি। এর জের ধরে ২ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর এজলাসে গালাগালি ও অশালীন আচরণের ঘটনা ঘটে। বিচারকের সঙ্গে এজলাস চলাকালে আইনজীবীদের বাদানুবাদের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

ভিডিওতে দেখা যায়, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়াসহ কয়েকজন আইনজীবী বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে গালাগাল করছেন। এ ঘটনায় আইনজীবীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর একটি চিঠি পাঠান বিচারক মোহাম্মদ ফারুক।

শুনানি শেষে ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সম্পাদকসহ তিন আইনজীবীর প্রতি আদালত অবমাননার রুল দেন হাইকোর্ট। রুলে তিন আইনজীবীর বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে তিন আইনজীবীকে ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে বলা হয়। এরপর বিচারককে গালাগাল ও অশালীন আচরণের ঘটনায় নিন্দা প্রস্তাব এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন সংগঠন।

এছাড়া ২২ নভেম্বর খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ) নির্মলেন্দু দাশের সঙ্গে অশোভন আচরণের জন্য খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবীকে তিরস্কার করেন হাইকোর্ট।

১৭ অক্টোবর পিরোজপুরের মুখ্য বিচারিক হাকিম (সিজেএম) আবু জাফর মো. নোমানের বিচারিক কাজে বাধা, হুমকি ও অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের ব্যাখ্যা জানতে ওই আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর খান মো. আলাউদ্দিনকে তলব করেন হাইকোর্ট। ২৬ নভেম্বর ইচ্ছেমতো আদালত পরিচালনা, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের প্রত্যাহারের দাবিতে আদালতের সার্বিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয় জেলা আইনজীবী সমিতি। ১৩ জুন লক্ষ্মীপুরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তারেক আজিজের আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *