রাজনীতি

বিএনপিকে নিয়ে হাফিজের ‘বোমা ফাটানো’ মন্তব্য

গত কয়েকদিন ধরে রাজনীতিতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদের সক্রিয়তা নিয়ে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। তিনি নতুন দল গঠন করছেন, এমন ইঙ্গিতও পাওয়া যায় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে।

যদিও এ তথ্য সঠিক নয় বলে জানান দিয়েছেন হাফিজ। আবার অনেকটা ‘বোমা ফাটানো’ মন্তব্যও করেছেন বিএনপিকে নিয়ে।
মেজর হাফিজ বলেছেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় রাজনীতি থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তার দল। এ মন্তব্য এখন টক অব দ্য টাউন।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জ্যেষ্ঠ নেতার এমন মন্তব্য বিএনপির রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।

দল নিয়ে মন্তব্যের পাশাপাশি নিজের সক্রিয়তার ব্যাপারেও কথা বলেন হাফিজ। তথ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে নতুন করে কোনো রাজনৈতিক দল খোলা তো দূরের কথা, শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার কথা ভাবছেন তিনি। একইসঙ্গে দলকে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালিত হতেও পরামর্শ দেন তিনি।

বুধবার (৮ নভেম্বর) বেলা ১১টায় বনানীতে নিজের বাসায় ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিজের অবস্থান তুলে ধরতে’ সংবাদ সম্মেলন করেন মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি এ সময় বলেন, অনেকগুলা ভুল আমরা করেছি, সেই দলীয় ভুল প্রকাশ করার জায়গা এটি না। আর এটা প্রকাশ করাও ঠিক হবে না। কিন্তু আমার তো কোনো ফোরাম নাই এবং দলে কোনো অবস্থান নাই। গত আট বছর দলে কোনো কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়নি। কোনো নেতা নির্বাচিত হয়নি। কারণ, নেতা নির্বাচন করার সুযোগ নেই এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির বক্তব্য রাখারও সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, আমার চোখ-কান নষ্ট না। আমি কোনো বধির স্কুলে পড়ি না। তবে জাতির স্বার্থে কিছু কিছু কথা বলতেই হয়। তবে আমার দেশ সবার উপরে। আমার নেতা জিয়াউর রহমান বলেছেন, দেশ সবার আগে। আমিও তাই মনে করি, সে জন্য দু-চারটি কথা বলছি। তবে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা রয়েছে।

বিএনপিতে সত্য কথা বলার মতো কোনো লোক নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, চেয়ারপারসনের সামনে সত্য বলার মতো লোক আমার সামনে পড়েনি। অনেক আগে সাইফুর রহমান সাহেব বলতেন; তিনি বিএনপির একজন ত্যাগী নেতা ছিলেন। এছাড়া বাকি সবাই ইয়েস স্যার, রাইট স্যার বলা আর কিছু জানেন না। এই হলো বাস্তবতা।

২০১৪ সালে নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করার দরকার ছিল। তখন আওয়ামী লীগের অবস্থা লেজে-গোবরে ছিল। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় দেওয়ার জন্য। কখন একজন এ আহ্বান জানায়? কারা এ ধরনের আহ্বান জানায়? আমরা সেই অবস্থার ফায়দা নিতে পারিনি। যে পথ অনুসরণ করেছি, সেই যে রাজপথে গেছি এখনো সেই রাজপথেই আছি।

হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, শারীরিক অসুস্থতার কারণেই সে নির্বাচনে আমার অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। আমি আমার নির্বাচনী এলাকায় জনগণের সঙ্গে মতবিনিময় করে রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার চিন্তা করব। তবে বিএনপির আগামী জাতীয় নির্বাচনে যাওয়া উচিত। দলে অনেক ত্যাগী নেতাকর্মী রয়েছেন, তারা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু বাস্তবতার কারণে এটি সম্ভব হয়নি। সুতরাং কেয়ারটেকার সরকারের ওপর জোর না দিয়ে বিকল্প খোঁজা উচিত। আমি মনে করি আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের সরকার কিছুই না।

দেশের সহিংসতা তরুণ-কিশোরদের ওপর প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে বিএনপির এ নেতা বলেন, প্রতিদিন টেলিভিশনে দেখি বাস জ্বলছে। সেটা আওয়ামী লীগের ক্যাডারও জ্বালাতে পারে আবার বিএনপি থেকেও জ্বালাতে পারে। অথবা অন্য কেউ। তবে এর দায় সম্পূর্ণ বিএনপির ওপর এসে পড়ছে। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দেশের অভিভাবক হিসেবে সব সমস্যার সমাধান খোঁজা উচিত।

হাফিজ উদ্দিন আরও বলেন, আমি মনে করি বিএনপি এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এই দলই ক্ষমতায় আসবে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনে আদায় করতে জানতে হবে। শুধুমাত্র রাজপথে স্লোগান দিলেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করে বাড়ি যাবে না। আমাদের আন্তর্জাতিক কানেকশন খুবই দুর্বল। সে সম্পর্ক জোরদার করার জন্য নেতৃবৃন্দ তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। অনেক সময় রাষ্ট্রদূতের কথাবার্তা এক পেশে মনে হয় এবং সেটারও কোনো বেনিফিট বিএনপি নিতে পারেনি। তবুও এখন বিএনপির উচিত কীভাবে আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া যায়, সেটা চিন্তা করা। আমি আশা করি আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে মাঠে থাকবে।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনি দলের সংস্কার করুন। এভাবে একটি রাজনৈতিক দল চলে না। কাউন্সিলের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্র কমিটি করবে। কেন্দ্রীয় কমিটির জেলা কমিটি করবে এবং জেলা কমিটি ও উপজেলা কমিটি করবে এভাবে হবে। সারা পৃথিবীতে এই পদ্ধতি মানা হয়, বাংলাদেশে হয় না। জিয়াউর রহমান এই আদর্শ অনুসরণ করতেন। তবে আমরা কেন এ থেকে সরে এলাম? এখন দেশে কমিটি বাণিজ্য হচ্ছে। ত্যাগী নেতারা কেন নির্বাসিত হচ্ছেন? তারেক রহমানের কাছে অনুরোধ করব ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করেন। সবাই আপনার অনুসারী, নিজের পকেট ভারী করার কোনো দরকার নেই। জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার ছেলে হিসেবে আপনি সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র। এটা আপনারই দল, তবে এটাকে গণতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনা করেন।

আগামী নির্বাচনের আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন মেজর হাফিজ। তিনি বলেন, তবে এটিও দিনের আলোর মতো সত্য যেকোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের সুষ্ঠু হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেও হবে না এবং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদের অধীনেও হবে না।

রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ অবসরে যাওয়ার বিষয়ে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয়। এখন আমার প্রায়োরিটি হলো শারীরিক সুস্থতা লাভ করা এবং চিকিৎসা করা। রাজনীতির প্রতি কোনো আগ্রহ এখন আর আমার অবশিষ্ট নেই।

গতকাল তথ্যমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমি বাংলাদেশের রাজনীতি ও বিএনপির মধ্যে একেবারেই একজন গুরুত্বহীন ব্যক্তি। বর্তমানে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। গত কয়েকদিন ধরে কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। অতি শীঘ্রই বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবো। শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। গত ১০ ডিসেম্বর বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু শারীরিক অবস্থার কারণে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ হয়নি। মোট কথা রাজনীতি থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছি। এমন এক সময় তথ্যমন্ত্রী বলেছেন আমি একটি নতুন দল করতে যাচ্ছি। যা একদমই সঠিক নয়। আমি এখন কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নই। আমি ৩১ বছর ধরে বিএনপির সদস্য।

তিনি আরও বলেন, অনেক ষড়যন্ত্র ও ভুল বোঝাবুঝিকে আমার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আর বেগম খালেদা জিয়া হচ্ছে আমার নেত্রী। তিনি যতদিন সুস্থ ছিলেন আমার কোনো সমস্যা ছিল না। এ ধরনের কোনো সংবাদ সম্মেলন আমার করতে হয়নি। আমি কমফোর্টেবলি জনগণের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেটা ক্ষমতায় থেকে বা বিরোধী দলে থেকেই হোক না কেন। তবে দুঃখের বিষয় বিগত দুবার নিজের ভোটটাও দিতে পারিনি।

২০১৮ সালের নির্বাচনে আমাকে আমার নির্বাচনী এলাকায় যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তারপর যখন আমি পুলিশ প্রোটেকশনে আমার নির্বাচনী এলাকায় গেলাম তখন আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী এবং পুলিশ সদস্যরা আমার বাড়ির চারপাশ ঘিরে রেখেছিল। যে কারণে সেবার আমি নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। ভোট দেওয়া তো দূরের কথা ওইদিন আমাকে ডিজিটাল সিকিউরিটি একটা মামলা উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। এই হচ্ছে আমার নির্বাচনের অভিজ্ঞতা। এমন অভিজ্ঞতা আমার মতো আরও অনেক বিরোধী দলের নেতার আছে। এরপর নির্বাচন থেকে সরে আসার পর আমার দলকে নাকি ৮০টি আসন দেবে নির্বাচনের পরে। আমি এই খবরও জানি না, আর এই ৮০ জনের মধ্যে আমি নিজেও ছিলাম না।

বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ১৪ নভেম্বর ২০২০ সালে আমার দল থেকে আমাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। তখন আমার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ ছিল। আমি দলে সক্রিয় না, দলের কোনো কাজ করি না, সংস্কারপন্থী, আমি নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম করি। এ ধরনের আজগুবি ১১টি অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম অভিযোগ ছিল- আমি শওকত মাহমুদের সঙ্গে বিজয় নগরে সরকার বিরোধী মিছিল করেছি। আমরা বিরোধী দল সরকার বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহণ করতেই পারি। তবে আমি এই মিছিলে কখনোই ছিলাম না। এসবে আমি কখনোই অংশগ্রহণ করিনি। তখন আমি শো-কজের লিখিত জবাবও দিয়েছি। তবে আমার বক্তব্যের জবাব দল থেকে পাইনি। জিয়াউর রহমানের সৈনিক হিসেবে এটি আমার জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *