ইউক্রেইনে যুদ্ধ লাগিয়ে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া রাশিয়া একশ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে প্রথমবার বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্লুমবার্গের বরাতে বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, ১০ কোটি ডলারের একটি কিস্তি শোধ করার জন্য রোববার পর্যন্ত সময় ছিল রাশিয়ার হাতে। ওই অর্থ তাদের হাতে ছিল এবং মস্কো তা দিতেও চাইছিল।
কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের হাতে ওই ডলার পৌঁছানোর কোনো উপায় আপাতত নেই।
বিবিসি লিখেছে, ঋণ খেলাপি হওয়া যে কোনোভাবে এড়াতে চাইছিল ক্রেমলিন, কারণ এটা রাশিয়ার মর্যাদার ওপর বড় ধরনের ধাক্কা। রুশ অর্থমন্ত্রী আন্তন সিলুয়ানভ এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন একটি ‘প্রহসন’ হিসেবে।
রাশিয়া বিদেশি ঋণে শেষবার খেলাপি হয়েছিল ১৯১৮ সালে, বলশেভিক বিপ্লবের সময় কমিউনিস্ট নেতা ভ্লাদিমির লেনিন জারশাসিত রুশ সাম্রাজ্যের ঋণ পরিশোধ করতে অস্বীকার করেছিলেন।
আর যে কোনো ধরনের ঋণের ক্ষেত্রে রাশিয়া শেষবার কিস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিনের মেয়াদের শেষ দিকে ওই সময়টায় রাশিয়া মারাত্মক রুবল সঙ্কটে ভুগছিল। সে কারণে অভ্যন্তরীণ বন্ডের সুদ দিতে ব্যর্থ হলেও বিদেশি ঋণে খেলাপি হওয়া এড়াতে পেরেছিল মস্কো।
কিন্তু এবার সেটা এড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইউরোপীয় মিত্রদের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে।
বিশ্বের প্রধান আন্তর্জাতিক লেনদেন পরিষেবা সুইফট থেকেও রাশিয়ার বড় ব্যাংকগুলোকে বাদ দেওয়া হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। ফলে রাশিয়ার রপ্তানি বাণিজ্যও মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়, কারণ নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার পণ্য কিনে এখন ডলারে দাম পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না কোনো দেশের পক্ষে।
রাশিয়া সরকার বলেছে, তারা তাদের সব কিস্তিই সময়মত পরিশোধ করতে চায় এবং রোববারের আগ পর্যন্ত তা পরিশোধ করতে তারা সক্ষমও হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত চার মাসে দেশে ও দেশের বাইরে ৪০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ তারা ডলার অথবা ইউরোতে শোধ করেছে।
রাশিয়ার কাছে ১৫টি আন্তর্জাতিক বন্ড রয়েছে যেগুলোর অভিহিত মূল্যে দেনার পরিমাণ প্রায় ৪০০ কোটি ডলার, যার অর্ধেকই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছে দেনা হিসেবে রয়েছে। এরকমই একটি বন্ডের কিস্তি বাবদ ১০ কোটি ডলার পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপি হতে হল মস্কোকে।
ছবি: রয়টার্সছবি: রয়টার্সএই কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত তারিখ আসলে ছিল ২৭ মে। ইউরোক্লিয়ার ব্যাংকের মাধ্যমে ওই অর্থ বিনিয়োগকারীদের হাতে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু সেখানেই সেখানেই টাকাটা আটকে যায়।
স্বার্বভৌম ঋণের কিস্তি নির্ধারিত তারিখে দিতে না পারলে ৩০ দিনের অন্তর্বর্তী সময় পাওয়া যায়। সেই সময়ের মধ্যে কিস্তি গ্রাহকের হাতে পৌঁছাতে পারলে খেলাপি হওয়া এড়ানো যায়। সেই একমাস রোববার শেষ হয়েছে, তার মধ্যে কিস্তি শোধ করার উপায় রাশিয়ার ছিল না।
ইউরোক্লিয়ার বলেছে, তারা রাশিয়ার কিস্তির অর্থ আটকে দেয়নি, কিন্তু নিষেধাজ্ঞা মানতে তারা বাধ্য।
রাশিয়া ঋণ খেলাপি হতে পারে- এ সম্ভাবনা গত ফেব্রুয়ারিতেও কারও মাথায় আসেনি। তাদের লেনদেন চিত্র সবসময় ভালো অবস্থাতেই ছিল।
যেসব দেশ খেলাপি হয়, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে তাদের প্রবেশাধিকার রহিত হয়, যদিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাশিয়া এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। তারপরেও, একবার খেলাপি হলে এর পরিণতি আরও অনেক দূর গড়াতে পারে।
এর ফলে বিনিয়োগকারীরা ক্রেডিট ডিফল্ট সোয়াপস (সিডিএস) নিয়মের দ্বারস্থ হতে পারেন। অর্থাৎ, সেসব বন্ডের বিপরীতে বীমা করা থাকলে বিনিয়োগকারীরা এখন সেখান থেকে টাকা চাইতে পারেন। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক জেপি মরগানের হিসাবে এরকম বীমা দাবির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৬ বিলিয়ন ডলার।
শুধু আন্তর্জাতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনাকারীরাই রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণের সঙ্গে যুক্ত নয়, অনেক রুশ বিনিয়োগকারীও পশ্চিমা ব্যাংকের মাধ্যমে ওই বন্ড কিনেছেন। যেহেতু এই বন্ডগুলো রাশিয়ার ব্যাংকগুলোরও মূলধনের একটি অংশের যোগান দিচ্ছে, তাই ওইসব ব্যাংকও ঝামেলায় পড়তে পারে।
মস্কো খেলাপি হওয়ায় রাশিয়ার করপোরেট মহলও ভুগতে পারে, যেহেতু তারা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকেই তাদের বিনিয়োগ সংগ্রহ করে থাকেন, যার পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলার।