ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কাছে জিম্মি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ২৩ নাবিক ভয়াবহ পানি সংকটে পড়েছে। এ কারণে তাদের ৪-৫ দিন পর একবার গোসল করতে দেওয়া হচ্ছে। এতে তাদের শরীরে দেখা দিয়েছে এলার্জিজনিত নানা সমস্যা। জিম্মি এক নাবিকের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
এদিকে জিম্মি নাবিক ও জাহাজ উদ্ধারের বিষয়ে হঠাৎ করেই মালিক পক্ষ মুখ বন্ধ করেছে। নাবিকদের মুক্তিপণের বিষয়ে কতটুকু কী হয়েছে, ঈদের আগে তাদের মুক্ত করা যাবে কিনা- এ বিষয়ে নতুন করে তাদের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে না। বক্তব্য নেওয়ার জন্য বুধবার কবির গ্রুপের অধীন এসআর শিপিংয়ের সিইও মেহেরুল করিমকে ফোন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মুক্তিপণ নিয়ে দস্যুদের প্রতিনিধির সঙ্গে দেনদরবার চলছে। অসমর্থিত সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সালে এই গ্রুপের আরেক জাহাজ এমভি জাহান মণি জাহাজ ও এর ২৭ নাবিককে মুক্ত করতে মালিক পক্ষকে ৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছিল। এটি উদ্ধার করতে সময় লেগেছিল ১০০ দিন। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে সময় কম লাগতে পারে। কিন্তু মুক্তিপণ বেশি লাগতে পারে। জাহাজে সোমালি ভাষা ও ইংরেজি ভাষা বলতে পারেন এমন একজন দোভাষী নিয়োগ করেন জলদস্যুরা। ওই দোভাষীর কথায় জিম্মি নাবিকরা বুঝতে পারছেন মুক্তিপণ নিয়ে দেনদরবার কিছু একটা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই জাহাজের এক নাবিকের স্বজন বলেন, জাহাজ জিম্মি করার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে বিশুদ্ধ পানি ফুরিয়ে এসেছে। প্রতিদিন ব্যবহারের জন্য এক ঘণ্টা পানি দেওয়া হচ্ছে। ওয়াশ রুমে ব্যবহার করতে হচ্ছে সাগরের পানি। ৪-৫ দিন পর একবার গোসল করতে দেওয়া হচ্ছে। যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন তারা ছাড়া অন্য নাবিকদের এক কেবিনেই গাদাগাদি করে রাখা হয়েছে। একদিকে প্রতিদিন গোসল করতে না পারা, অন্যদিকে গাদাগাদি করে রাখার কারণে প্রায় প্রত্যেক নাবিকের চর্মরোগজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তারা বেশ অস্বস্তিতে আছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ইসরাত জাহান বলেন, ‘৪-৫ দিন গোসল না করলে যে কোনো মানুষ ইম্পেটিগো বা ত্বকে খোসপাঁচড়া হতে পারে। শরীরের ঘাম থেকে ব্যাকটেরিয়াজনিত দাদ রোগে ভুগতে পারেন। তাছাড়া এ ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অন্যরাও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’
গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে এমভি আবদুল্লাহ। দুই দিনে তিন দফা স্থান বদল করে এই জাহাজ নেওয়া হয় সোমালিয়ার গোদবজিরান উপকূলে। উপকূল থেকে দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে জাহাজটি অবস্থান করছে। ভারী অস্ত্র নিয়ে জলদস্যুরা পাহারা দিচ্ছে জিম্মি নাবিকদের। এরই মধ্যে ইইউ যুদ্ধজাহাজ, ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজও জিম্মি জাহাজটিকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। জিম্মি নাবিকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কোনো ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না। সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তিপণ দিয়েই নাবিকদের অক্ষত ও নিরাপদে উদ্ধারে স্বজনদের মতামত যেমন আছে, তেমনি মালিক পক্ষও সেটি চাইছে। জিম্মি করার এক সপ্তাহ পর ২০ মার্চ জলদস্যুদের প্রতিনিধি মুক্তিপণ নিয়ে মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলে আশার আলো দেখা দেয়। তবে যোগাযোগের পর আরও এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। এই এক সপ্তাহে অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে সে বিষয়ে সর্বশেষ আপডেট আর পাওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে মালিক পক্ষও নতুন করে কিছু বলছে না।
সূত্র জানায়, জাহাজ জিম্মি করার পর কোন প্রক্রিয়ায় কোথা থেকে টাকা সংগ্রহ করে দস্যুদের কাছে পৌঁছানো হবে তা নিয়েই চলছে আলোচনা। কৌশলগত কারণে তাই মালিক পক্ষ জিম্মি মুক্তির বিষয়ে নতুন করে কিছু বলছে না। নাবিক পরিবারকেও এ বিষয়ে বাড়তি কিছু না বলার জন্য বলে দেওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, ২০১০ সালে এস আর শিপিংয়ের এমভি জাহাজ মণি নামে যে জাহাজটি সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল সেটি জিম্মি করার ১০০ দিন পর উদ্ধার হয়। ওই জাহাজের ২৭ নাবিককেও তখন অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছিল। মালিক পক্ষ স্বীকার না করলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ওই জাহাজটি ৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার করা হয়েছিল। হেলিকপ্টারে করেই সরাসরি জলদস্যুদের কাছে মুক্তিপণের ডলার পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ও জিম্মিদের উদ্ধার করতে এবার এর চেয়ে বেশি ডলার খরচ করতে হতে পারে মালিক পক্ষকে। শুরুতেই জলদস্যুরা ৫ মিলিয়ন ডলার মুক্তিপণ দাবি করেছে- এমন খবর প্রচার হলেও মালিক পক্ষ এর সত্যতা নিশ্চিত করেনি।
গত ১২ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়ার পথে সোমালিয়ার প্রায় ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে ভারত মহাসাগর থেকে চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিংয়ের জাহাজটি দখলে নেয় একদল সশস্ত্র জলদস্যু। তারা জাহাজটিকে প্রথমে সোমালিয়ার গারাকাড উপকূলে নিয়ে যায়। পরে আরও প্রায় ৫০ মাইল দূরে গোদবজিরান উপকূলসংলগ্ন এলাকায় স্থানান্তর করে। জাহাজটি বর্তমানে উপকূল থেকে দেড় নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে।